“নোটবুক রাইটার্স কেয়ার”
পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য – ১
শুরুর_কথা
একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু করি।
একটা অনলাইনভিত্তিক সাহিত্যনির্ভর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে “পাণ্ডুলিপি আহ্বান” সংক্রান্ত একটা পোস্ট দেয়ার পর নবীন সদস্যদের মধ্যে একটা গুঞ্জন দেখা গেলো। সবার একটাই প্রশ্ন, পাণ্ডুলিপি আবার কী? এই শব্দটার অর্থ কী?
অথচ তাদের অধিকাংশই ফেসবুকে লেখালেখি করেন, শখের বশে বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের লেখা জমা দিয়ে ছোটখাটো পুরস্কারসহ সনদও জিতে নিয়েছেন অনেকে। কারো লেখা আবার বিভিন্ন যৌথ গ্রন্থেও সন্নিবেশিত রয়েছে বিভিন্নভাবে।
অথচ আশ্চর্য এটাই যে, আমাদের এই কোমল-নবীনেরা এমনভাবে ডিজিটালাইজড্ হয়ে গেছে, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, তারা “পাণ্ডুলিপি” কী, তা জানেই না!
গল্প আপাতত শেষ। এবার আমরা কাজের কথায় আসি।
#পাণ্ডুলিপি_কী
আপনি যা লিখছেন, যা যা সাহিত্যকর্ম আপনি একত্রিত করে সাজিয়ে রেখেছেন, তা-ই হচ্ছে পাণ্ডুলিপি। অর্থাৎ আপনার একক ও মৌলিক লেখনীই হচ্ছে পাণ্ডুলিপি। কী? খুব সহজ, সাধারণ আর স্বাভাবিক না? অথচ এই “সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস” বিষয়টাই আপনি জানতেন না এতদিন!
#কীভাবে_হয়
“সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস”টা কেমন, একটু বলি। পাণ্ডুলিপির ইতিহাস এবং প্রক্রিয়া(প্রসেসিং) খুব একটা সহজ বা সংক্ষিপ্ত না।একটা সময় পাণ্ডুলিপি মাত্রই কেবল হার্ডকপি ছিলো, নিউজপ্রিন্ট থেকে শুরু করে হোয়াইট, অফসেট কাগজ অব্দি ছিলো পাণ্ডুলিপির বিচরণ। তাতে প্রুফ রিডার আর সম্পাদকের কাটাকুটি-ঘষামাজার পর প্রতিটি লাইনের ফাঁকে আর পিঁপড়েটা দাঁড়াবার ঠাঁই থাকতো না। একে বলা হতো ড্রাফট্ বা খসড়া। তারপর নতুন করে সাজানো হতো পাণ্ডুলিপিটি।
দ্বিতীয়বারেও ঈষৎ ঘষামাজা হয় বটে, তবে তৃতীয়টা সাধারণত হয়ে থাকে নির্ভুল, শ্রুতিমধুর ও দৃষ্টিনন্দন। এমনকি অনেক খুঁতখুঁতে লেখক পাঁচ থেকে ছয়বার পর্যন্ত পাণ্ডুলিপির খসড়া করে থাকেন, যাতে সমস্ত দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে চলে যায় তার লেখা বইটি। অনেক সময় এমনও হয়, লেখক নিজেই নিজের পাণ্ডুলিপি চিনতে পারেন না!
আচ্ছা, শেষ করে নিই।
এরপর পাণ্ডুলিপিটি ছাপাখানায় চলে যেতো। ফর্মা অনুযায়ী ছাপার মূল্য(প্রিন্টিং কস্ট বা Printing cost), প্রচ্ছদ ও অলংকরণ(Art & Illustration), পৃষ্ঠা সাজানো(Page editing), কালি(Ink/Colour), বাঁধাই(Binding), প্রাসঙ্গিক ছবিসহ অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়াদি যুক্ত করা, ক্ষেত্রবিশেষে গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি ইত্যাদি কত কাজ রে বাবা! সব একত্র করে একটা পরিমাণ খরচ ধার্য করা হতো, যা গড় করে বইপ্রতি মূল্যটা পাওয়া যেতো। সেটাই হচ্ছে বইটির মুদ্রণমূল্য, যাকে সুন্দর করে বলা যায় হাদিয়া। আচ্ছা, আমরা ব্যাখ্যামূলক বাণিজ্যিক কথাবার্তায় আপাতত যাচ্ছি না।
এদিকে যার পাণ্ডুলিপি নিয়ে এই তুমুল কর্মযজ্ঞ, সেই লেখক মশায় যদি পুরনো হন, তবে তো তাকে “রাজামশাই” বললেও ভুল হবে না। তাঁর আগের প্রকাশিত গ্রন্থাবলী যদি বাজারে কাটতি পেয়েছে, তো তিনি আক্ষরিক অর্থেই “মহাশয়” প্রমাণিত। তিনি রয়্যালটি হাতে নিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বিরিয়ানির দোকানে চলে যান, মিষ্টির দোকানেও যেতে পারেন। আবার সত্যিকারের লেখকমশায় রয়্যালটির ধার ধারেন না। তিনি লেগে যান পরের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজে।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে, পাণ্ডুলিপি লিখে প্রকাশকের হাতে পৌঁছে দিয়েই লেখক নিশ্চিন্ত হয়ে চা খেতে পারেন! বরং তখন লেখক সাহেবের প্রতিটা নিঃশ্বাসে হামানদিস্তার শব্দ হতে থাকে এই ভেবে যে, এত যত্ন করে, কষ্ট করে, শ্রম ও আবেগ দিয়ে লেখা পাণ্ডুলিপিটির স্থান প্রকাশকের ডাস্টবিনে হয়ে যাবে না তো?
হ্যাঁ, বন্ধুরা। সহজভাবে বলতে গেলে, একটা পাণ্ডুলিপিকে একটা চূড়ান্ত গ্রন্থে রূপ দেয়ার কাজে নিবেদিত থাকে একাধিক মস্তিষ্ক, অগণিত পরিশ্রমী হাত।
এবার বোঝা গেছে তো?
গভীর রাতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে ভাবুক দৃষ্টিতে বসে থেকে, ব্যস্ততম নগরীর অলিতে-গলিতে চোখ-কান মেলে চলতে চলতে, বর্ষণমুখর বিকেলে উদাস নয়নে বসে ভাবতে ভাবতে, কাঠফাটা রোদে মরীচিকাময় পিচঢালা পথের দিকে চেয়ে থেকে, বাস স্টপেজ-রেলস্টেশন-নৌকাঘাটের মত জনবহুল এলাকায়, খোলা মাঠ-স্তব্ধ উপত্যকা-সাগর পাহাড়ঘেরা গ্রামের মত জনমানবহীন অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে……. যা যা দেখে মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে পরবর্তীতে এই সকল লেখনীকে এক মলাটে লিপিবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় আপনি নিয়োজিত আছেন, ঠিক সেগুলোই আপনার পাণ্ডুলিপি।
#কীভাবে_সাবমিট_করবো
আজকাল তো পাণ্ডুলিপিকে আর কষ্ট করে কাগজ-কলমে লিখতে হয় না, ফোনের নোটপ্যাড, আইপ্যাড, ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটারের কিবোর্ডে খটাখট টাইপ করে তা কপিপেস্ট করে নিয়ে আলাদা ফাইল বা এটাচমেন্ট বানিয়ে নিলেই হয়, ব্যস্!
কোনো প্রকাশনী পাণ্ডুলিপি আহ্বান করামাত্রই আপনার তৈরি পিডিএফ বা ডক ফাইলটি ইমেইল বডিতে এটাচ করে পাঠিয়ে দেবেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়!
আর যদি হার্ডকপি থাকে, তাহলে পাণ্ডুলিপিটির একটা কপি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিন প্রকাশনীর ঠিকানায়। কত্ত সহজ না?
তবে –
তবে…
তবে?
একটা ছোট্ট কথা আছে। পাণ্ডুলিপি কিন্তু যাচ্ছেতাই কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং হলেই হবে না! কারণ, আপনার একখানা “পাণ্ডুলিপি”র পেছনে এত এত বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরা খাটনি খাটবেন, একজন প্রকাশক তার বিরাট পরিমাণ অর্থমুদ্রা লগ্নি করবেন, একজন সম্পাদক তার সেরা দক্ষতাটা বিনিয়োগ করবেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে – একজন সাধারণ পাঠক বিনা দ্বিধায়, বিনা চ্যালেঞ্জে নিজের কষ্টের পয়সা খরচ করে পাণ্ডুলিপিটির সভ্য-রূপ আপনার “বই”টি কিনবেন, পড়বেন, শিখবেন, জানবেন, আনন্দ পাবেন, হৃদয়ের খোরাক মেটাবেন।
সুতরাং!
সেই পাণ্ডুলিপিটি নিশ্চয়ই
“কাঁঠাল গাছে বেল,
আমার গোঁফে তেল,
পাণ্ডুলিপি ভীষণ সহজ
আজকে হবে খেল!”
টাইপের লেখা লিখে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভর্তি করলেই হবে না!
তাহলে কেমন হবে পাণ্ডুলিপির ধরন-ধারণ?
উত্তর নিয়ে আসছি পরের পোস্টে, আগামী শনিবার, ঠিক এই সময়ে। ততক্ষণ নোটবুকের সঙ্গেই থাকুন।
©সাদিয়া সুলতানা
#NotebookWritersCare
#নোটবুক_টিম